সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

ভুমিকা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঠান্ডা যুদ্ধের (আরও পড়ুন) সময় আর একটি সংকট বিশ্বকে আণবিক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল, তা ছিল কিউবা সংকট। কিউবা হল ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপ। দেশটি চিনি উৎপাদনের জন্য জগৎবিখ্যাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত লাইন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এই দেশটির উপর। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে কিউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল। মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ফ্যালজেনিকো বাতিস্তা ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে কিউবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

ফিদেল কাস্ত্রোর ক্ষমতালাভ: বাতিস্তা সরকারের আমলে দেশে দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অসাম্য, স্বৈরাচার প্রভৃতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। ফলে মার্কিন মদতপুষ্ট এই সরকারের প্রতি কিউবার জনগণের সমর্থন ছিল না। বাতিস্তা সরকারের অপদার্থতার সুযোগে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারি ফিদেল কাস্ত্রো কিউবায় এক অভ্যন্তরীণ বিপ্লব ঘটিয়ে দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করেন।

কিউবাতে বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হলে আমেরিকার সাথে কিউবার বিরোধের সূচনা হয়। যেমন-

(১) কাস্ত্রো কিউবায় আমেরিকার সমস্ত সম্পত্তি এমনকি চিনি কলের জাতীয়করণ করেন। 

(২) রাশিয়া, চিন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করেন।

মার্কিন প্রতিক্রিয়া: কিউবার কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে সমস্ত রকম কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ক্ষুদ্ধ আমেরিকা কিউবাকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়। মার্কিন উদ্যোগে কাস্ত্রো সরকারকে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে ১৪০০ জন কাস্ত্রো বিরোধীকে কিউবার পিগ উপসাগরে অবতরণ করায়। বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য প্রস্তুত ছিল মার্কিন বি-২৬ বিমান। কিন্তু মাত্র দু-দিনের মধ্যে কাস্ত্রো এই বিদ্রোহ দমন করে। তথাপি মার্কিন প্রশাসন কাস্ত্রোকে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে বদ্ধ পরিকর হয় এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন কেনেডি ঘোষণা করেন আমরা কিউবাকে কমিউনিস্টদের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না। এই পরিস্থিতিতে কিউবা রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হন।

কিউবায় রাশিয়ার ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ: এই ঘটনার এক বছরের মধ্যেই রাশিয়া কিউবাকে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ঘোষণা করে, কিউবাতে রাশিয়া সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এমনকি রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ ঘোষণা করেন যে "কিউবার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য রাশিয়া তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে। এই কারণেই রাশিয়া কিউবায় ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ করে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার উদ্দেশ্য দুটি ছিল-

(১) কিউবাতে ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি নির্মান করে আমেরিকাকে চাপে রাখা।

(২) ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের চুক্তি অনুসারে সোভিয়েত রাশিয়া কিউবাতে ৪৮টি মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মিগ-২১ ও ২৪টি আনবিক বোমার বিমান সরবরাহ করা।

       আকাশ ও নৌপথে যখন রাষ্ট্রপতি কেনেডি কিউবা অবরোধ ঘোষণা করেন। রুশ ও মার্কিন দুপক্ষই সেনাবাহিনী প্রস্তুত রাখে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি অপসারণ করলে, মার্কিন নৌ অবরোধ প্রত্যাহার করে।

গুরুত্ব: প্রায় টানা দুসপ্তাহ ধরে কিউবাকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্ব জুড়ে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হলেও কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। তবুও বিশ্ব রাজনীতিতে কিউবা সংকটের গুরুত্ব ছিল সুদুরপ্রসারী, যেমন-

(১) কিউবা সংকট প্রমাণ করেছিল বিশ্বের যে-কোনো সমস্যা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায় এবং এর মধ্য দিয়ে দাঁদাত (আরও পড়ুন) রাজনীতির উদ্ভব ঘটে।

(২) দক্ষিণ আমেরিকায় প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে কিউবার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

(৩) কিউবাকে কেন্দ্র করে পরমাণু যুদ্ধের সৃষ্টি হলেও উভয়পক্ষ যেভাবে শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান করে তার ফলে মানবতার জয় সুনিশ্চিত হয়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সূচনা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ পূর্বতন মুঘল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে তুলে দেন। কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা [1] পাঁচসালা বন্দোবস্ত : গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ কমিটি' গঠন করেন। যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে রাজি হত, এই ভ্রাম্যমাণ কমিটি তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত প্রদান করত। পুরোনো জমিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব নিতে অক্ষম হলে, তিনি জমিদারি হারাতেন। এই ব্যবস্থা 'ইজারাদারি ব্যবস্থা' বা 'পাঁচসালা বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বতন সুপারভাইজারদের তিনি নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’, যারা জেলার রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাম্যমাণ কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হ...