সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিংশ শতকে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করো।

সূচনা: ইউরোপের বেশ কয়েকটি শক্তিশালী দেশ পঞ্চদশ শতক থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া দেশে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি.) পরবর্তীকালে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।


উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের কারণ

[1] পশ্চিমি শোষণ: পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি দীর্ঘকাল ধরে তাদের নিজ নিজ উপনিবেশে তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ চালায় এবং উপনিবেশগুলি থেকে শোষণ করা অর্থসম্পদের সহায়তায় নিজ দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধি ঘটায়। উপনিবেশ থেকে সস্তায় সংগ্রহ করা কাঁচামালের সাহায্যে পশ্চিমি দেশগুলির শিল্প কারখানায় শিল্প উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, বিদেশি শিল্পজাত পণ্য দেশীয় বাজার দখল করে নিলে উপনিবেশগুলির স্থানীয় কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়, শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়ে এবং উপনিবেশের স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এরূপ বিদেশি শোষণের ফলে উপনিবেশের বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ফলে তারা পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হয়।

[2] পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব: পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ভাবধারার যথেষ্ট প্রসার ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংস্পর্শে এলে এই সমস্ত উপনিবেশগুলির মানুষের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনা জন্ম নেয়। এর ফলে উপনিবেশের শিক্ষিত বাসিন্দারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী চেতনা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।

[3] পশ্চিমি সংস্কৃতির বিরোধিতা: পশ্চিমি ইউরোপীয় দেশগুলি তাদের অধীনস্থ উপনিবেশগুলির নিজস্ব সভ্যতা ও শিক্ষা-সংস্কৃতিকে খুবই নীচু নজরে দেখত। এজন্য তারা উপনিবেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লুপ্ত করার উদ্দেশ্যে সেখানে নিজেদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও পাশ্চাত্যের ভাবধারার প্রসার ঘটাতে শুরু করে। প্রথমদিকে মূলত উপনিবেশের শহরগুলিতে পাশ্চাত্য ভাষা, শিক্ষা ও ঐতিহ্যের প্রসার ঘটে। 

[4] উদারনৈতিক ভাবধারা: আধুনিককালে ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উদারনৈতিক শিক্ষা ও ভাবধারার দ্রুত প্রসার ঘটে। বেন্থাম, জেমস মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ হিতবাদী চিন্তাবিদ রাষ্ট্রের ক্ষমতার সংকোচন করে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রসারের সপক্ষে প্রচার চালান। হিতবাদ ও উদারনীতিবাদের মূল কথাগুলি শুধু ব্রিটেনের ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা মহাসাগর অতিক্রম করে এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলির শোষিত মানুষদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।

[5] বিদেশি শিক্ষাগ্রহণ: উনিশ শতক থেকে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে অনেকে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়। তারা ব্রিটেন তথা ইউরোপের উদারনৈতিক শাসন ও নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।

[6] আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি: পশ্চিমি ভাবধারার সংস্পর্শে আসার ফলে উপনিবেশগুলির বাসিন্দারা নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। তারা বিদেশি শক্তির অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি জানাতে থাকে।

উপসংহার: উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের জেরে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তাদের উপনিবেশগুলি ধরে রাখতে অক্ষম হয়ে পড়ে। ফলে তারা বিভিন্ন উপনিবেশগুলিকে একে একে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সূচনা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ পূর্বতন মুঘল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে তুলে দেন। কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা [1] পাঁচসালা বন্দোবস্ত : গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ কমিটি' গঠন করেন। যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে রাজি হত, এই ভ্রাম্যমাণ কমিটি তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত প্রদান করত। পুরোনো জমিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব নিতে অক্ষম হলে, তিনি জমিদারি হারাতেন। এই ব্যবস্থা 'ইজারাদারি ব্যবস্থা' বা 'পাঁচসালা বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বতন সুপারভাইজারদের তিনি নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’, যারা জেলার রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাম্যমাণ কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হ...