সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী প্রায় ৩৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকে পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে এবং অধিকাংশ উপনিবেশ সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
উপনিবেশবাদের অবসানের কারণ
[1] বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে তারা দূরদূরান্তের উপনিবেশগুলিতে আধিপত্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়।
[2] রাশিয়ার চাপ: রাশিয়া ভেবেছিল যে, ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হওয়ার পর সেসব দেশে সমাজতন্ত্রের প্রসার সম্ভব হবে। এই উদ্দেশ্যে রাশিয়া প্রকাশ্য উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে পশ্চিমি দেশগুলিকে তাদের উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা দানের উদ্দেশ্যে চাপ দিতে থাকে।
[3] আমেরিকার চাপ: আমেরিকা মনে করেছিল যে, ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হওয়ার পর সদ্য-স্বাধীন দেশগুলিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার এবং বাণিজ্যিক অগ্রগতি সম্ভব হবে। তাই আমেরিকা বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় যে, উপনিবেশবাদের প্রসারকে সে সমর্থন করবে না।
[4] স্বাধীনতা দানের প্রতিশ্রুতি: ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এই অবস্থায় তারা নিজেদের উপনিবেশগুলি থেকে সাহায্যলাভের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে তারা উপনিবেশগুলি থেকে সাহায্য লাভের বিনিময়ে যুদ্ধের পর উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দানের প্রতিশ্রুতি দেয়। যুদ্ধের পর উপনিবেশগুলি এই প্রতিশ্রুতি পালনের দাবি জানায়।
[5] পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাব: উপনিবেশগুলিতে পাশ্চাত্য দর্শন, জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ভাবধারার প্রসারের ফলে উপনিবেশগুলির বাসিন্দাদের মনে গণতন্ত্র, সাম্য, স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পায়। ফলে সেসব দেশে পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে বিরোধিতার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
[6] উদারনীতিবাদের প্রসার: অষ্টাদশ শতক থেকে ব্রিটেন তথা ইউরোপে জেরেমি বেন্থাম, জেমস মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ হিতবাদী দার্শনিকরা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালান। এর ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ইউরোপে জনমত গড়ে ওঠে এবং ঔপনিবেশিক সরকারগুলির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। ইউরোপীয় দার্শনিকদের প্রচারের ফলে উপনিবেশগুলির বাসিন্দাদের মনে গণতন্ত্র, সাম্য ও স্বাধীনতার চেতনা বৃদ্ধি পায়। উপনিবেশের প্রগতিশীল বহু নাগরিক পশ্চিমি দেশগুলি থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে স্বদেশে ফিরে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়।
[7] প্রতিদ্বন্দ্বিতা: উপনিবেশের প্রসার এবং অন্যান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তির মধ্যে তীব্র অন্তর্বিরোধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এই বিরোধের ফলে কোনো কোনো ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র তার শত্রু দেশের উপনিবেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করে এবং বিদ্রোহীদের গোপনে সহায়তা করে। ফলে উপনিবেশের মুক্তিসংগ্রাম তীব্র হয়ে ওঠে।
[৪] জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন: ভারত, যুগোশ্লাভিয়া, মিশর প্রভৃতি দেশগুলি একদা শোষণমূলক ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়েছিল বলে স্বাধীনতা লাভের পর তারা কোনো জোটে শামিল হতে চায়নি ফলে এইসব দেশের নেতৃত্বে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ও প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি করা হয়। জোটনিরপেক্ষ আদর্শে উদ্বুদ্ধ নেতাদের ভূমিকা বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ- বিরোধী আন্দোলনকে সক্রিয় করে তোলে।
[9] জাতিপুঞ্জের ভূমিকা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অন্যতম কর্মসূচি ছিল বিশ্বের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানো। জাতিপুঞ্জের সনদের বিভিন্ন অংশে উপনিবেশগুলিকে মুক্তিদানের কথা বলা হয়েছে। জাতিপুঞ্জের উদ্যোগের ফলে বহু উপনিবেশের মুক্তি ঘটে এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর তারা জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ গ্রহণ করে।
উপসংহার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে উপনিবেশগুলিতে পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন