সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বার্লিন অবরোধ বা বার্লিন সংকট আলোচনা করো।

সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পটসডাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জার্মানিকে সোভিয়েত রাশিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এই চারটি দেশের কর্তৃত্বাধীনে চারটি পৃথক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এখানে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজেদের আলাদা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। রাশিয়া চেয়েছিল তার অধিকার করা পূর্ব জার্মানিতে এক তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু মিত্রশক্তি চেয়েছিল তাদের অধিকার করা অঞ্চলগুলি নিয়ে পশ্চিম জার্মানি গঠন করতে। এর ফলে জার্মানি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় বার্লিন সংকট।

বার্লিন অবরোধ বা বার্লিন সংকট

বার্লিন অবরোধের পটভূমি : পটসডাম সম্মেলনে (১৯৪৫ খ্রি., ১৭ জুলাই থেকে ২ আগস্ট) চার বৃহৎশক্তিবর্গ (সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স) একজোট হয়ে বার্লিন সংকটের পটভূমি রচনা করে। সম্মেলনে ঠিক হয়—

[1] ‘৫টি ডি’ প্রয়োগ: জার্মানির ওপর ‘৫টি ডি ’ (Five Ds) — demilitarisation (বেসামরিকীকরণ), deindustrialisation (অবশিল্পায়ন), decentralisation (বিকেন্দ্রীকরণ), democratization (গণতন্ত্রীকরণ), de-Nazification (অবনাৎসিবাদীকরণ) প্রয়োগ করা হবে।

[2] জার্মানির বিভাজন: জার্মানিকে চার ভাগে ভাগ করা হবে —  

  1. সোভিয়েত রাশিয়ার অঞ্চল : ওডার-নিস নদীর তীর বরাবর এলব পর্যন্ত অঞ্চল, 
  2. মার্কিন অঞ্চল : জার্মানির দক্ষিণ অঞ্চল, 
  3. ব্রিটিশ অঞ্চল : জার্মানির উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল, 
  4. ফ্রান্সের অঞ্চল : জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল।

[3] একই অর্থনৈতিক নীতি : চারভাগে বিভক্ত হলেও সমগ্র জার্মানিতে অর্থনৈতিক নীতি থাকবে একটিই। জার্মানির চারটি ভাগে একই অর্থনীতি চালু রাখার জন্য বার্লিনে গঠিত হবে ACC (Allied Control Council) |

[4] বার্লিনের বিভাজন: জার্মানির রাজধানী বার্লিনকেও চার ভাগে ভাগ করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়।

সোভিয়েত কর্তৃক বার্লিন অবরোধ : বার্লিন ছিল পূর্ব জার্মানির অংশ আর তাই তা ছিল রাশিয়ার কর্তৃত্বাধীন। আবার পশ্চিম জার্মানিতে মার্কিনিরা যে আর্থিক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় তাতে রাশিয়া ক্ষুদ্ধ হয়েছিল। এর ফলে সোভিয়েত রাশিয়া পশ্চিমি রাষ্ট্রজোটের পূর্ব বা পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশের সড়কপথ (যা ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার অধীনস্থ) অবরোধ করে (১৯৪৮ খ্রি., ২৪ জুলাই)। এই ঘটনা বার্লিন অবরোধ (Berline Blocked) নামে পরিচিত। বার্লিন অবরোধে রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি — 1.পশ্চিমি শক্তিজোটের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বার্লিন শহরকে মুক্ত করা। 2. পশ্চিম জার্মানিতে আমেরিকা ও ব্রিটেনের নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনাকে বানচাল করা।

সংকটের অবসান: রাশিয়ার বার্লিন অবরোধের ফলে পশ্চিম জার্মানিতে চরম খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ব্রিটেন ও আমেরিকা রাশিয়ার অবরোধের কাছে নতিস্বীকার না করে দীর্ঘ এগারো মাস ধরে ১৪০০ বিমানের সাহায্যে আকাশপথে অবরুদ্ধ বার্লিন অঞ্চলকে প্রতিদিন আট হাজার টন খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ, তেল, কয়লাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগান দেয়। এই ঘটনা 'Barlin Airlift' নামে খ্যাত। স্টালিন এই আকাশপথে সরবরাহ ব্যবস্থার বিরোধিতা করার সাহস দেখাতে পারেননি। অবশেষে বাধ্য হয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ২৯৩ দিন পর অবরোধ তুলে নেয় (১৯৪৯ খ্রি., ১২ মে)।


বার্লিন সংকটের ফলাফল : বার্লিন সংকটের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।

[1]জটিলতা বৃদ্ধি : বার্লিন সংকট আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছিল। আমেরিকা সাম্যবাদের প্রসার রোধ করতে চাইলে রাশিয়াও পুঁজিবাদের প্রসার রোধে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে বিশ্বরাজনীতি জটিল রূপ ধারণ করে।

[2] জার্মানিতে আলাদা সরকার : মার্কিন জোটের মদতে পশ্চিম জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র (Federal Republic of Germany, FRG) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম জার্মানির প্রধান হলেন খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক দলের কনরাড আদানুর। আর রুশ জোটের মদতে পূর্ব জার্মানি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (German Democratic Republic. GDR) হিসেবে পরিচিতি পায়। এই সরকারের কর্ণধার হলেন অটো প্রোটোহল। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যে কংক্রিটের ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছিল।

[3] সামরিক শক্তি বৃদ্ধি : এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে বৃহৎ শক্তিভুক্ত দেশগুলি নিজেদের সামরিক শক্তিকে আরও মজবুত করার দিকে নজর দেয়। যার পরিণতি হিসেবে পরবর্তীকালে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির উদ্ভব ঘটে। 


বার্লিন সংকটের গুরুত্ব

ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে বার্লিন অবরোধ (১৯৪৮ খ্রি., ২৪ জুলাই থেকে ১৯৪৯ খ্রি., ১২ মে) একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সান্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই ঘটনার 'গুরুত্ব অপরিসীম। 

[1] স্টালিনের নীতির ব্যর্থতায় : এই অবরোধের পরিণতি সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে শুভ হয়নি। এর দ্বারা স্টালিনের নীতির ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়। 

[2] ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতায়: এই ঘটনা ঠান্ডা লড়াইকে তীব্রতর করে তোলে। 

[3] রাশিয়া ও পশ্চিমি গোষ্ঠীর বিচ্ছেদে : পশ্চিমি গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার অবিশ্বাস প্রকাশ্য বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

[4] জার্মানির বিভাজনে : ধনতন্ত্রী ও সাম্যবাদী এই দুটি ভিন্নধর্মী শাসন প্রক্রিয়ায় জার্মানি বিভক্ত হয়ে যায়। 

[5] রুশ বিরোধী মার্কিন নীতি গ্রহণে : পশ্চিম ইউরোপে ট্রুম্যানের ভূমিকা সম্পর্কে এতদিনের দ্বিধাগ্রস্ত মার্কিন সেনেট এই ঘটনার পর তাঁর তীব্র রুশ বিরোধী নীতির পূর্ণ সমর্থকে পরিণত হয়। 

[6] সামরিক জোটগঠন: সর্বোপরি, এই ঘটনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সামরিক শক্তিজোট গঠনের প্রক্রিয়াকে মতি দেয়।

উপসংহার: বার্লিন সংকট পশ্চিমি শক্তিগুলিকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে। পশ্চিম ইউরোপে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হয়, যার ফলস্বরূপ উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (NATO বা North Atlantic Treaty Organisation) গঠিত হয়। বার্লিন সংকটে সোভিয়েত রাশিয়ার অনমনীয় মনোভাব বিশ্বরাজনীতিতে তাকে অনেকটাই কোনঠাসা করে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সূচনা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ পূর্বতন মুঘল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে তুলে দেন। কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা [1] পাঁচসালা বন্দোবস্ত : গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ কমিটি' গঠন করেন। যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে রাজি হত, এই ভ্রাম্যমাণ কমিটি তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত প্রদান করত। পুরোনো জমিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব নিতে অক্ষম হলে, তিনি জমিদারি হারাতেন। এই ব্যবস্থা 'ইজারাদারি ব্যবস্থা' বা 'পাঁচসালা বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বতন সুপারভাইজারদের তিনি নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’, যারা জেলার রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাম্যমাণ কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হ...