সূচনা : ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের পরিকল্পনা অনুসারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নতুন ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা ভারতীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য তার তিনজন সদস্যকে ভারতে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয় (১৯৪৬ খ্রি., ২৪ মার্চ)। ভারত-সচিব লর্ড পেথিক লরেন্স, বাণিজ্য-সচিব স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং নৌ-সচিব মি. এ. ভি. আলেকজান্ডার—এই তিনজন মন্ত্রীকে নিয়ে গড়া উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এই দলটি ভারত-ইতিহাসে ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন (১৯৪৬ খ্রি.) নামে খ্যাত।
মন্ত্রী মিশনের উদ্দেশ্য: মন্ত্রী মিশনের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দুটি–
[1] ভারতকে স্বাধীনতা দান এবং ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য যে গণপরিষদ তৈরি হবে তার গঠন, পদ্ধতি ও নীতি নির্ধারণ করা।
[2] ভারতের সকল রাজনৈতিক দলগুলির বৃহত্তর মতৈক্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালের জন্য একটি জনপ্রতিনিধিভিত্তিক সরকার গঠন করা।
মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব
মন্ত্রী মিশনের প্রধান প্রস্তাবগুলি হলো—
[1] যুক্তরাষ্ট্র গঠন: ভারতে একটি দ্বিস্তরবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে। দেশীয় রাজ্যগুলি এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে পারবে।
[2] ক্ষমতা বন্টন: কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। কেবলমাত্র পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর, বাকি ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে।
[3] প্রদেশ গঠন: ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলিকে তিনটি বিভাগে বিভক্ত করা হবে—মাদ্রাজ, বোম্বাই, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশা নিয়ে গঠিত হিন্দুপ্রধান বা ক বিভাগ; পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ, সিন্ধু নিয়ে গঠিত মুসলিম প্রধান বা খ বিভাগ এবং বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি পৃথক বিভাগ বা গ বিভাগ। এই বিভাগগুলির নিজ নিজ আঞ্চলিক সংবিধান প্রণয়নের অধিকার থাকবে।
[4] গণপরিষদ গঠন: ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানে ইচ্ছুক দেশীয় রাজ্য ও প্রদেশগুলির নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হবে।
[5] যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের অধিকার: নতুন সংবিধান চালু হলে যে কোনো নির্বাচিত প্রাদেশিক আইনসভা ইচ্ছা করলে যে-কোনো বিভাগে যোগ দিতে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেও পারবে।
[6] অন্তর্বর্তী সরকার: যতদিন না নতুন সংবিধান প্রণীত হয়, ততদিন ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধি নিয়ে একটি অন্তবর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
মন্ত্রী মিশনের ত্রুটি
[1] ভারত বিভাজনের পথ প্রস্তুত: মন্ত্রী মিশন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ভাগের প্রস্তাব রাখেন। মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে প্রদেশগুলিকে হিন্দু প্রধান ও মুসলিম প্রধান— এই দু-ভাগে ভাগ করার উল্লেখ থাকায় পরোক্ষভাবে ভারত বিভাজনের পথই প্রস্তুত হয়।
[2] দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো: মন্ত্রী মিশন প্রদেশগুলিকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং কেন্দ্রের হাতে শুধুমাত্র পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপরেখা ফুটে ওঠে।
মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলির গুরুত্ব
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
[1] অবিভক্ত রাখার শেষ প্রয়াস হিসেবে: মন্ত্রী মিশন স্পষ্টই বুঝে গিয়েছিল যে, ভারত ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টি এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের সঠিক কোনো পথ নয়। তাই ভারতকে অবিভক্ত রেখে স্বাধীনতা দেওয়ার এটাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের শেষ আন্তরিক প্রয়াস।
[2] প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারদানে: এই প্রথম দেশীয় রাজ্যের জনগণকে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।
[3] অসাম্প্রদায়িক শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবে: এতদিন শাসনতান্ত্রিক আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতার সৃষ্টি হত। মন্ত্রী মিশন তা থেকে মুক্তি পেতে হিন্দু, মুসলিম ও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে শিখ ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়কে সেক্ষেত্রে স্বীকৃতি না দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করে।
[4] অভারতীয় সদস্যগ্রহণের ক্ষেত্রে: গণপরিষদে কোনো অ-ভারতীয় সদস্য গ্রহণের প্রস্তাব ছিল না।
[5] গণপরিষদের ক্ষমতায় : ভারতীয় শাসনতন্ত্র রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদকেই সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন