সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব আলোচনা করো।

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পটভূমি 

সূচনা: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ কর্তৃক প্রবর্তিত রাওলাট আইনের চরম পরিণতি ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে এই কুখ্যাত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আহূত হয়, যেখানে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ব্রিটিশের ঘাতক পুলিশবাহিনী গুলি চালিয়ে শান্তিপূর্ণ জমায়েতকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করে। এই কুখ্যাত ঘটনাটি ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক টমসন ও গ্যারাটের মতে—জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা সিপাহি বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পটভূমি নীচে উল্লেখ করা হল—

[1] পাঞ্জাবে নির্যাতন: জুলুম চালিয়ে যুদ্ধের জন্য পাঞ্জাব থেকে সেনা ও অর্থ সংগ্রহ, ‘গদর' বিদ্রোহ প্রতিরোধ প্রভৃতি উদ্দেশ্যে সরকার পাঞ্জাবে তীব্র দমনপীড়ন চালালে পাঞ্জাব ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবের কর্মচ্যুত সেনাদের সমাবেশে এই ক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও ডায়ারের অত্যাচারী শাসন পাঞ্জাবকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করে।

[2] রাওলাট আইন: ভারতীয়দের স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ এবং আন্দোলন কঠোর হাতে দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী রাওলাট আইন প্রবর্তন করে। এই নিষ্ঠুর দমনমূলক আইনের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠে। এই আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাব বারুদের স্তূপে পরিণত হয় ।

[3] নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার: ‘পিপল্‌স্‌ কমিটি' নামে একটি গণসংগঠন লাহোর ও অমৃতসরে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে মদত দেওয়ার অভিযোগে সরকার অমৃতসরের দুই নেতা ড. সৈফুদ্দিন কিচলু ও ড. সত্যপালকে (১০ এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রি.) গ্রেপ্তার করে। ফলে পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এদিকে গান্ধিজিকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে লাহোরে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। পাঞ্জাবের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে জনতার খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। উত্তেজিত জনতা সরকারি অফিস-আদালত, টেলিগ্রাফ লাইন ও অন্যান্য সরকারি সম্পত্তিতে আক্রমণ চালায় ।

[4] অমৃতসরে সামরিক শাসন: রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর হাতে অমৃতসর শহরের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। এই বাহিনী অমৃতসরে সামরিক আইন জারি করে ১১ এপ্রিল শহরে জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।

হত্যাকাণ্ড : পাঞ্জাবের শাসনকর্তা মাইকেল ও ডায়ার এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে সর্বত্র সভাসমিতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র মানুষ ১৩ এপ্রিল (১৯১৯ খ্রি.) বিকালে অমৃতসর শহরের পূর্বপ্রান্তে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে এক উদ্যানে শান্তিপূর্ণভাবে এক সভায় সমবেত হয়। সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিনা প্ররোচনায় অমৃতসরের ভারপ্রাপ্ত সামরিক অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ব্রিটিশ সৈন্য ৫০টি রাইফেল থেকে ১০ মিনিট ধরে গুলিবর্ষণ করে। যদিও সরকারি মতে নিহতের সংখ্যা ৩৭৯ এবং আহতের সংখ্যা ১২০০ জন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতে দু-হাজারেরও বেশি নরনারী হতাহত হয়। এর ওপর সান্ধ্য আইন জারি করা হয় যাতে আহতদের কাছে নিকটজনেরা পৌঁছোতে না পারে।


জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া / গুরুত্ব

ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এক কলঙ্কজনক ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (১৯১৯ খ্রি., ১০ এপ্রিল)। ব্রিটিশ বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ভারতীয় রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড একদিকে যেমন বিশ্ববাসীর সামনে ব্রিটিশের স্বরূপ উন্মোচন করেছিল, অপরদিকে তেমন এই হত্যাকাণ্ডের প্রভাবে ভারতবাসী আরও তীব্রভাবে ব্রিটিশবিরোধী হয়ে উঠেছিল।

[1] ভারতবাসীর তীব্র প্রতিক্রিয়া : জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারতবাসী তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাঁর রাজসম্মান নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেন। জাতীয় কংগ্রেস অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এই ঘটনার নিন্দা করে। গান্ধিজি 'ইয়ং ইন্ডিয়া' পত্রিকায় তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লেখেন— এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে ধ্বংস করতেই হবে।

[2] রাওলাট সত্যাগ্রহ প্রত্যাহার : রাওলাট আইনের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা সত্যাগ্রহ আন্দোলনে হিংসার অনুপ্রবেশ ঘটছে দেখে গান্ধিজি রাওলাট সত্যাগ্রহ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। ব্রিটিশের প্ররোচনায় ভারতবাসী যাতে হিংসার আশ্রয় না নেয়, তার জন্য গান্ধিজি অচিরেই এই আন্দোলন প্রত্যাহার করেন (১৯১৯ খ্রি., ১৮ এপ্রিল তিনি তাঁর রাওলাট সত্যাগ্রহ কর্মসূচিকে 'হিমালয় সদৃশ ভুল' বলেও অভিহিত করেন।

[3] তদন্ত কমিটি গঠন: ভারতবাসীর ক্ষোভ প্রশমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার হান্টারের নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের লক্ষ্যে এক কমিটি গঠন করে। কিন্তু এই কমিটিকে কংগ্রেস নেতারা বয়কট করে। কংগ্রেস একক উদ্যোগে আলাদা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন—গান্ধিজি, মতিলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাশ, বদরউদ্দিন তায়েবজি প্রমুখ।

[4] ব্রিটিশের স্বরূপ উন্মোচন: জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সমগ্র বিশ্বের কাছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের স্বরূ উন্মোচন করে। নিজেদের সুসভ্য জাতি বলে পরিচয় দিলেও এই হত্যাকাণ্ড ব্রিটিশ জাতিকে কলঙ্কিত করে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ব্রিটিশ দেখিয়ে দেয় যে নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার কোন স্তর পর্যন্ত তারা যেতে পারে।

[৫] ব্রিটিশ শাসকবর্গের অনুশোচনা: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ঘটনা (জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড) ব্রিটিশ শাসকবর্গকে অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ করে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়ক চার্চিল বলেন—জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো শোচনীয় ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আর কখনও ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। তৎকালীন ভারত-সচিব মন্টেগু এই ঘটনাকে 'নিবারণমূলক হত্যাকাণ্ড' (Preventive murder) বলে অভিহিত করেন।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সূচনা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ পূর্বতন মুঘল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে তুলে দেন। কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা [1] পাঁচসালা বন্দোবস্ত : গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ কমিটি' গঠন করেন। যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে রাজি হত, এই ভ্রাম্যমাণ কমিটি তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত প্রদান করত। পুরোনো জমিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব নিতে অক্ষম হলে, তিনি জমিদারি হারাতেন। এই ব্যবস্থা 'ইজারাদারি ব্যবস্থা' বা 'পাঁচসালা বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বতন সুপারভাইজারদের তিনি নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’, যারা জেলার রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাম্যমাণ কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হ...