সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মৌখিক ঐতিহ্য (Oral Traditions)-র বিভিন্ন দিক আলোচনা করো।

সূচনা: ভাষা এবং গানের মধ্যে মৌখিক ঐতিহ্যগুলি রূপ নিয়েছে। লোককাহিনি, প্রবাদ, গাথাকাহিনি, গান এবং স্তুতি হিসেবে।

মৌখিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক

[1] মৌখিক ঐতিহ্যের সংজ্ঞা: মৌখিক ঐতিহ্য হল এমন এক সংস্কৃতিগত ধারণা যা এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মে লোকমুখে প্রচলিত হয়। বিভিন্ন দিক থেকে মৌখিক ঐতিহ্যের সংজ্ঞা দেওয়া যায়।

  • সাক্ষাৎকারের তথ্য সংগ্রহভিত্তিক: শ্রবণ, শ্রবণ-বীক্ষণ প্রভৃতি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পূর্বনির্ধারিত বা পরিকল্পিত সাক্ষাৎকার গ্রহণের দ্বারা ব্যক্তি বিশেষ বা ঘটনাভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ বা চর্চাকে মৌখিক ঐতিহ্য (Oral Traditions) বলে।
  • মৌখিক বার্তাভিত্তিক: জান ভ্যানসিনা (Jan Vansina) তাঁর 'Oral Tradition as History' গ্রন্থে লিখেছেন মৌখিক ঐতিহ্য হল “এক ধরনের মৌখিক বার্তা যা কথা, গান প্রভৃতির মাধ্যমে মুখে মুখে পূর্ববর্তী প্রজন্ম অতিক্রম করে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছোয়।
  • তথ্য বিশ্লেষণ ও চর্চাভিত্তিক: ওরাল হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (Oral History Association) -এর মতে “অতীতের ঘটনা সম্পর্কে মানুষের কণ্ঠস্বর, স্মৃতিকথা, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও চর্চা করাকেই মৌখিক ইতিহাস বলে।”

[2] মৌখিক ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য: মৌখিক ঐতিহ্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল —

  • সাক্ষাৎকার: মৌখিক ঐতিহ্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সাক্ষাৎকার অর্থাৎ কোনো কাহিনি বা ঘটনার একটি চরিত্রের সঙ্গে অন্য চরিত্রের সাক্ষাতের কথোপকথন মৌখিকভাবে বর্ণিত হয়।
  • অলিখিত: মৌখিক ঐতিহ্য হল অলিখিত এক সাংস্কৃতিক বিষয় ও ঐতিহ্য। যেখানে দলিল দস্তাবেজ বা মহাফেজখানার নথিপত্রগুলি ছাড়াই লোকমুখে প্রচারিত কাহিনি বা ঘটনাকেই গ্রহণ করা হয়। যার ওপর ভিত্তি করে লিখিত ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা হয়।
  • সংরক্ষণ: সুপ্রাচীন অতীতের কোনো ঘটনা বা কাহিনির বিবরণ লোকমুখে শোনার পর অনেকে সেগুলি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। কেউ কেউ সংরক্ষণের উপায় হিসেবে সেগুলিকে নথিভুক্ত বা রেকর্ড করে রাখেন । এ ছাড়া লোকমুখে শোনা কোনো কাহিনি বা ঘটনার তথ্যসূত্রগুলি বিভিন্ন মহাফেজখানা, গ্রন্থাগার, মঠ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
  • উৎস: সার্বিয়ান পণ্ডিত ভুক-স্টিফেন্‌ভিক কারাডজিক (যিনি ছিলেন গ্রিম ভ্রাতৃবর্গের সমসাময়িক এবং বন্ধু) সর্বপ্রথম মৌখিক ঐতিহ্য অধ্যয়নের ক্ষেত্ররূপে তার উৎসের সন্ধান দেন।

[3] লোক-ঐতিহ্যের বিকাশ

  • বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বারা: কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাল্যান নেভিন্‌স (Allan Nevins) 'কলম্বিয়া ওরাল হিস্ট্রি রিসার্চ অফিস' প্রতিষ্ঠা (১৯৪৮ খ্রি.) করে মৌখিক ঐতিহ্যের আধুনিক ধারণার বিকাশ ঘটান। আমেরিকায় মৌখিক ইতিহাসবিদগণ ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে 'ওরাল হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন' এবং ব্রিটিশ মৌখিক ইতিহাসবিদগণ ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে 'ওরাল হিস্ট্রি সোসাইটি' প্রতিষ্ঠা করেন।
  • বি. বি. সি-র প্রচেষ্টা: ১৯৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বি.বি.সি. (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন) বিভিন্ন বেতারকেন্দ্র বিশ্বের নানা দেশের বহু ব্যক্তির মুখ থেকে মৌখিক ইতিহাস রেকর্ড করে। এই রেকর্ড করা মৌখিক ইতিহাস বি. বি. সি. "The Century Speaks' শিরোনামে ৬৪০টি পর্বে সম্প্রচার করে।

[4] উদাহরণ: ইতিহাসের জনক গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস রচিত ইতিহাস গ্রন্থে গ্রিস ও পারস্যের মধ্যেকার যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বা প্রত্যক্ষদর্শী লোকজনের মুখ থেকে শোনা যুদ্ধের ঘটনাবলি তিনি লিপিবদ্ধ করেন। প্রাচীন ভারতে আর্যদের বৈদিক সাহিত্য শ্রুতসাহিত্য বলে অভিহিত হয়েছে। প্রথমদিকে বেদ লিখিত অবস্থায় ছিল না। বংশপরম্পরায় গুরুর কাছ থেকে শুনে শুনে শিষ্যরা এগুলি মনে রাখত বলে বেদের অপর নাম হয় শ্রুতি।

[5] ত্রুটি

  • ভুল তথ্যের অনুপ্রবেশ: মৌখিক ঐতিহ্য লোকমুখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রচারিত হয়। তাই এতে অনেক সময় ভুল তথ্যের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে।
  • প্রক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা: বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন সময়ে মৌখিক ঐতিহ্যের সুবাদে কোনো কাহিনি বা বিষয়বস্তুতে অনেক তথ্যসূত্র প্রক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়।

[6] মৌখিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব

  • প্রথমত, ইতিহাসের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে অনেক সময় মৌখিক ঐতিহ্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
  • দ্বিতীয়ত, সমাজের নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনার উৎস হিসেবে অনেক সময় মৌখিক ঐতিহ্যকে ব্যবহার করা হয়। 
  • তৃতীয়ত, ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যখন প্রকৃত লিখিততথ্যের অভাব থাকে, তখন মৌখিক ঐতিহ্যই প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে।

উপসংহার: স্মৃতিকথার মতোই মৌখিক ঐতিহ্যও অনেক সময় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে তথ্যের যোগান দেয়। তবে এক্ষেত্রেও প্রকৃত ঘটনা বা বিষয়বস্তুর সঠিক উপস্থাপনার অভাব থাকতে পারে।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সূচনা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ পূর্বতন মুঘল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে তুলে দেন। কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা [1] পাঁচসালা বন্দোবস্ত : গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ কমিটি' গঠন করেন। যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে রাজি হত, এই ভ্রাম্যমাণ কমিটি তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত প্রদান করত। পুরোনো জমিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব নিতে অক্ষম হলে, তিনি জমিদারি হারাতেন। এই ব্যবস্থা 'ইজারাদারি ব্যবস্থা' বা 'পাঁচসালা বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বতন সুপারভাইজারদের তিনি নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’, যারা জেলার রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাম্যমাণ কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হ...