সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঔপনিবেশিক ভারতের শিল্পায়নে সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো। ভারতের শিল্প-শ্রমিকের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে কী জানো ?

ঔপনিবেশিক ভারতের শিল্পায়নে সামাজিক প্ৰভাব

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার ভারতকে তাদের শোষণের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। বিদেশি পুঁজিপতিরা ভারতে পুঁজি বিনিয়োগ করে এদের শিল্পের যথেষ্ট প্রসার ঘটায়। তবে এই পুঁজি খাটিয়ে যে মুনাফা তারা অর্জন করত তা বিদেশে চলে যেত এবং ভারতের পরিবর্তে বিদেশের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটাত। ইউরোপীয় ও দেশীয় উদ্যোগে ভারতে আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটে। ভারতীয় সমাজে শিল্পায়নের বিভিন্ন প্রভাব পড়েছিল, যেমন—

[1] অর্থনীতিতে পরিবর্তন : শিল্পায়নের প্রভাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের পারসি, গুজরাটি, মাড়োয়ারি প্রভৃতি বণিক সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটে। ফলে ভারতের কৃষিভিত্তিক স্থবির অর্থনীতি গতিশীল ও প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে।

[2] নগরায়ণ: দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলগুলিকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন নগর গড়ে ওঠে। এই নগরগুলি পরে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

[3] গ্রাম-জীবনে অবক্ষয়: শিল্পায়নের ফলে ভারতের বিভিন্ন শহরে আধুনিক কলকারখানা স্থাপিত হয়। গ্রামের বহু দরিদ্র কৃষক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে নগদ মজুরি পাওয়ার আশায় গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে শহরে চলে আসতে শুরু করে। ফলে ভারতের গ্রাম-জীবনে ভাঙন শুরু হয়।

[4] সর্বভারতীয় চেতনা: ভারতের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল ও শিল্প- নগরীগুলিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের আগমন ঘটে। এসব কেন্দ্রে তাদের মধ্যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পারস্পরিক আদানপ্রদান সম্ভব হয়। এভাবে তাদের মধ্যে এক ধরনের সর্বভারতীয় চেতনা গড়ে ওঠে যা ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটায়।

[5] মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব: শিল্পায়নের ফলে ভারতীয় সমাজের শ্রেণি-কাঠামো পালটে যায় এবং জন্ম হয় দুটি নতুন শ্রেণি— পুঁজিপতি মালিকশ্রেণি ও দরিদ্র শ্রমিকশ্রেণি। ভারতীয় পুঁজিপতিদের সংখ্যা খুব কম হলেও তারা ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

[6] কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি: ভারতে শিল্পায়নের প্রসারের ফলে কৃষকদের ওপর শিল্পের প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য বা কাঁচামাল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চাপ বাড়তে থাকে। ফলে বহুক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন না করে শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদন করতে বাধ্য হয়।

ভারতের শিল্প-শ্রমিকের উদ্ভব ও বিকাশ

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এদেশে শিল্প শ্রমিকের উদ্ভব ঘটে। এ বাংলার পাটশিল্প, আসাম ও উত্তর-বঙ্গের চা-বাগিচা, বিহার ও বাংলার কয়লাখনি, দক্ষিণ ভারতের কফি-বাগিচা, পশ্চিম ভারতের বস্ত্র কারখানা প্রভৃতিতে নিযুক্ত হত। এই শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল—

[1] শ্রমিকদের ঠিকানা : বাংলার শিল্প শ্রমিকদের একটি বড়ো অংশ আসত বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মাদ্রাজ প্রভৃতি ভিন রাজ্যগুলি থেকে। অন্যদিকে গুজরাট ও বোম্বাইয়ের শ্রমিকদের অধিকাংশই ছিল সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা।

[2] ধীর গতি: ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতে শ্রমিকশ্রেণির বিকাশের গতিও ছিল খুব ধীর। একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের যেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল ৩০ কোটি ৩০ লক্ষ, সেখানে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২১ লক্ষ।

[3] পেশাগত পরিবর্তন: গ্রামের কৃষি ও হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ নিজেদের চিরাচরিত পেশা ছেড়ে কাজের আশায় শহরের কলকারখানাগুলিতে এসে ভিড় করে।

[4] প্রতিবাদ : শ্রমিকদের অবস্থা খুবই করুণ ছিল। শ্রমিকরা পুঁজিবাদী মালিকদের শোষণের বিরুদ্ধে সঙ্গবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের পথে পা বাড়িয়ে নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ে তৎপর হয়ে ওঠে। কাজের সময় জাল করা, মজুরি বৃদ্ধি প্রভৃতি দাবিতে তারা আন্দোলনে শামিল হত।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সূচনা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ পূর্বতন মুঘল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে তুলে দেন। কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা [1] পাঁচসালা বন্দোবস্ত : গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ কমিটি' গঠন করেন। যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে রাজি হত, এই ভ্রাম্যমাণ কমিটি তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত প্রদান করত। পুরোনো জমিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব নিতে অক্ষম হলে, তিনি জমিদারি হারাতেন। এই ব্যবস্থা 'ইজারাদারি ব্যবস্থা' বা 'পাঁচসালা বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বতন সুপারভাইজারদের তিনি নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’, যারা জেলার রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাম্যমাণ কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হ...