নানকিং-এর সন্ধি
1 সন্ধি স্বাক্ষর: আফিম যুদ্ধে ব্রিটেন চিনকে হারিয়ে দেয়। পরাজিত চিন যুদ্ধ শেষে বিজয়ী ব্রিটেনের সঙ্গে এক সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয় । চিনা কমিশনার চি-ইং (Chi-ying) এবং নব নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার হেনরি পট্টিনগার (Sir Henry Pottinger)-এর উদ্যোগে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত হয় নানকিং চুক্তি (২৯ আগষ্ট, ১৮৪২ খ্রি.)। এই সন্ধি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আফিম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
2 সন্ধির শর্তাবলি: এই চুক্তির শর্তগুলি হল—[i] চিন গ্রেট ব্রিটেনকে হংকং সমর্পন করবে অর্থাৎ হংকং ইংরেজদের অধীনে আসবে। [ii] চিন সর্বমোট ব্রিটেনকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২১ মিলিয়ন ডলার দেবে। এই ২১ মিলিয়নের মধ্যে ১২ মিলিয়ন ডলার সামরিক খরচ বাবদ, ৬ মিলিয়ন ডলার আফিমের ক্ষতিপূরণ বাবদ এবং ৩ মিলিয়ন ডলার ব্রিটিশ বণিকদের কাছে হং বণিকদের ঋণ পরিশোধ বাবদ। [iii] ক্যান্টন, অ্যাময়, ফুচাও, নিংপো এবং সাংহাই—এই পাঁচটি বন্দর ইংরেজ বণিকদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। ওই বন্দরগুলিতে ব্রিটিশ কনসাল, ব্রিটিশ বণিকগণ এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা বসবাস করতে পারবে। [iv] খুব কম সময়ের মধ্যে এক নির্দিষ্ট পণ্যশুল্কের হার নির্ধারণ করা হবে। আমদানি ও রপ্তানির উপর অভিন্ন (Uniform) এবং অনতিরিক্ত (Moderate) পণ্যশুল্ক আরোপ চিন মেনে নেবে। [v] ব্রিটিশ প্রতিনিধি পটিনগার (Pottinger) চোরাকারবারি (বিনা শুল্কে আমদানি- রপ্তানি) বন্ধের জন্য সাহায্য করবেন। [vi] ব্রিটেন ও চিনের মধ্যে সরকারি চিঠিপত্র আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে সমতা নীতি বজায় রাখা হবে। [vii] ইতিপূর্বে যেসব চিনা বণিকগোষ্ঠীকে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়েছিল তা বাতিল হবে।
আফিম বাণিজ্যই ছিল আফিম যুদ্ধের মূল কারণ। কিন্তু, সন্ধিতে শুধুমাত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া আফিমের ক্ষতিপূরণ ছাড়া আফিম বিষয়ক অন্যান্য উল্লেখ ছিল না। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ব্রিটিশ প্রতিনিধি পটিনগার আশা প্রকাশ করেন এই বলে যে, চিনা সরকার আফিম আমদানি আইনসিদ্ধ করবে ও নিয়ন্ত্রণ করবে। বাস্তবে নানকিং চুক্তির পরেও ইংল্যান্ড চিনে আফিম রপ্তানি বন্ধ করেনি। ব্রিটেনের পক্ষে রানি ভিক্টোরিয়া পরবর্তী সময়ে এই সন্ধির শর্তগুলির প্রতি সমর্থন জানান (২৮ ডিসেম্বর, ১৮৪২ খ্রি.)।
তিয়েনসিনের সন্ধি
1 সন্ধি স্বাক্ষর: দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধে চিন হেরে যায়। ইঙ্গ-ফরাসি যৌথ বাহিনী ক্যান্টন দখল করে নেয় (২৮ ডিসেম্বর, ১৮৫৭ খ্রি.)। পরাজিত চিন ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা ও রাশিয়ার সাথে আলাদা আলাদা ভাবে চারটি সন্ধি স্বাক্ষর করে। এই সন্ধিগুলি তিয়েনসিনের সন্ধি (Treaty of Tientsin) নামে পরিচিত।
2 শর্তাবলি: এই সন্ধির অন্যতম কয়েকটি শর্ত ছিল — [i] আগেকার সন্ধিগুলিতে প্রাপ্ত সুবিধাসমূহ বহাল থাকবে। [ii] পাশ্চাত্য দেশগুলির বাণিজ্যের জন্য আরও ১১টি নতুন বন্দর খুলে দেওয়া হবে। এই বন্দরগুলি হল—চিনকিয়াং, চেফু, হ্যানকাও, কিউকিয়াং কিউংঝা নিউচিয়াং, সোওয়াটাও, ওয়েনচাও, নানকিং, তেংচাও ও তামসুই। [iii] ইয়ংসি থেকে হ্যানকাও পর্যন্ত নদীপথ বিদেশি বণিকরা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করতে পারবে। [iv] বিদেশি বণিক কোম্পানিগুলি তাদের কনসাল অনুমোদিত এবং চিনা কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রতিস্বাক্ষরিত পাসপোর্ট নিয়ে চিনের ভিতরে যে-কোনো জায়গায় যেতে পারবে। বন্দর থেকে তেত্রিশ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত যেতে হলে কোনো অনুমতিপত্র লাগবে না। [v] ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্টান্ট মিশনারিরা চিনের ভিতরে অবাধে ধর্মপ্রচারের অধিকার পাবে। [vi] পণ্যসামগ্রীর আড়াই শতাংশের অধিক অভ্যন্তরীণ শুল্ক ধার্য করা চলবে না। [vii] যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে চিন ব্রিটেনকে ৪ মিলিয়ন টেইল এবং ফ্রান্সকে ২ মিলিয়ন টেইল দিতে বাধ্য থাকবে। [vii] পাশ্চাত্য দেশগুলি সমমর্যাদার ভিত্তিতে পিকিং-এ দূতাবাস স্থাপন করবে এবং তারা সেখানে স্থায়ী দূত রাখতে পারবে।
তিয়েনসিন চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তির শর্তগুলি কার্যকর করার জন্য চুক্তিবদ্ধ দেশগুলির বিদেশি রাষ্ট্রদূতগণ পিকিং-এ উপস্থিত হন। পিকিং কনভেনশন নামে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বলা হয় চিনের রাজধানী পিকিং-এ ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের স্থায়ী আবাস তৈরি হবে। চিন ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে যুদ্ধ জনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ আট মিলিয়ন টেইল দেবে। তিয়েনসিন বন্দর বিদেশিদের অবাধ বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য খুলে দেওয়া হবে। চিনের ভিতরে ফরাসি ক্যাথোলিক মিশনারিরা ভূ-সম্পত্তি কেনার এবং গৃহ তৈরির অধিকার লাভ করবে। কুলি ব্যাবসা আইনসিদ্ধ হবে। ব্রিটেন চিনের মূল ভূখণ্ডের কাওলিন উপদ্বীপটির অধিকার পাবে। ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে যাবতীয় বাজেয়াপ্ত ক্যাথোলিক সম্পত্তি চিনা সম্রাট রোমান ক্যাথোলিক চার্চকে ফিরিয়ে দেবেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন