সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্ব আলোচনা করো।

ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির উপনিবেশ প্রসারের কৌশল ‘নয়া উপনিবেশবাদ' ও ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদ' নামে পরিচিত। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে জে. এ. হবসন এবং ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ সম্পর্কে তাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।

হবসনের ব্যাখ্যা


ব্রিটিশ অর্তনীতিবিদ জে. এ. হবসন তাঁর 'সাম্রাজ্যবাদঃ একটি সমীক্ষা' নামক গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যার প্রধান বিষয়গুলি হল— 

[1] অর্থনৈতিক মুনাফা লাভ: হবসনের মতে, সাম্রাজ্যবাদের পিছনে কোনো মহৎ, বা উচ্চতর লক্ষ্য নয়, অর্থনৈতিক মুনাফাই ছিল নয়া উপনিবেশকারীদের প্রধানতম উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সমাজে ধনসম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের ফলে পুঁজিপতিদের হাতে যে ‘মূলধনের পাহাড়' সৃষ্টি হয়, সেই মূলধন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে তারা মুনাফা লাভের পরিকল্পনা করে।

[2] পুঁজিপতিদের চাপ: হবসন মনে করেন যে, নতুন ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগ করার জন্য পুঁজিপতিরা নিজ দেশের সরকারকে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে। অর্থাৎ হবসনের মতে, বাড়তি মূলধনের চাপই সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ।

[3] অর্থনৈতিক শোষণ: হবসন দেখিয়েছেন যে, অধিক মুনাফা ও সম্পদ অর্জনের জন্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র উপনিবেশ থেকে ধারাবাহিকভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উপনিবেশের বাজারে নিজেদের শিল্পজাত পণ্য বিক্রয় করতে থাকে। এইভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক উপনিবেশগুলি শোষিত হয় এবং পরিণামে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে।

[4] ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসানের উপায়: হবসনের মতে, এই ব্যবস্থার প্রতিকার করতে হলে পুঁজিপতিদের বাড়তি মূলধন দরিদ্র শ্রেণির মানুষগুলোর মধ্যে বিতরণ এবং বিভিন্ন উন্নয়নকার্যে তা ব্যবহার করতে হবে। তাঁর মতে, যদি লোকের জীবনযাত্রার মান বাড়ে, তবে তারা কলকারখানায় তৈরি বাড়তি জিনিস কিনে উদ্‌বৃত্ত মালকে ব্যবহার করতে পারবে। ফলে উদ্‌বৃত্ত মালের বিক্রির জন্য উপনিবেশ দখলের দরকার হবে না।

লেনিনের ব্যাখ্যা


রাশিয়ার বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রসারের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর 'সাম্রাজ্যবাদঃ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর' নামক গ্রন্থে (১৯১৬ খ্রি.)। এ সম্পর্কে তাঁর প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল-

[1] পুঁজির উদ্ভব এবং তা বিনিয়োগ: ইউরোপের দেশগুলিতে শিল্পের অগ্রগতি ঘটার ফলে পুঁজিপতিদের হাতে বিপুল পরিমাণ পুঁজি জমা হয়। এবার তারা আরও বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য সেই পুঁজি পুনরায় বিনিয়োগ করতে উদ্যত হয় এবং এজন্য তারা বেছে নেয় উপনিবেশগুলিকে। তারা উপনিবেশ থেকে সংগ্রহ করা কাঁচামাল নিজের দেশে না নিয়ে গিয়ে উপনিবেশেই পুঁজি বিনিয়োগ করতে চায়। তাই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পুঁজিবাদী শ্রেণির স্বার্থে উপনিবেশ দখল করে এবং পুঁজিবাদীরা সেখানেই পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা চালায়।

[2] বাজার দখল ও কাঁচামাল সংগ্রহ: অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শিল্প মালিকরা নিজ দেশের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই পণ্য উৎপাদনের জন্য সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং সেই পণ্যকে বিক্রি করার জন্য প্রয়োজন ছিল উপনিবেশের। লেনিনের মতে, এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি উপনিবেশ দখলের চেষ্টা চালায়। 

[3] প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সাম্রাজ্যবাদ: লেনিন বলেছেন, “পুঁজিবাদের জঠরে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম”। উপনিবেশ দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে যায়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা জন্ম দেয় যুদ্ধের। অর্থাৎ পুঁজিবাদী অর্থনীতিই হল যুদ্ধের জন্মদাতা—যার সূত্রপাত হয় উপনিবেশ দখলকে কেন্দ্র করে।

[4] অনুগত অভিজাত শ্রমিক শ্রেণির প্রতিষ্ঠা : পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, মালিক শ্রেণির কর্তৃক শ্রমিক শ্রেণির শোষণ ৷ কিন্তু লেনিনের মতে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিকে উপনিবেশে পরিণত করে সেখানকার নতুন শ্রমিক শ্রেণির ওপর শোষণ চালালেও নিজ দেশের শ্রমিকদের উৎকোচ দিয়ে বশীভূত করেছিল। কারণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির লক্ষ্য ছিল নিজ দেশের এই অনুগত ‘অভিজাত শ্রমিক শ্রেণি'-কে শ্রমিক বিপ্লব থেকে বিরত রাখা।

মূল্যায়ণ: উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন ও লেনিনের তত্ত্ব সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই তত্ত্বের ভ্রান্তি ধরা পড়ে। তবে এই তত্ত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তাই ডেভিড থমসনকে সমর্থন করে বলা যায় যে, সাগরপারে নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র সন্ধানের আগ্রহই ইউরোপীয় দেশগুলিকে উপনিবেশ দখলে বিশেষ উদ্যোগী করে তুলেছিল।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সূচনা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ পূর্বতন মুঘল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে তুলে দেন। কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা [1] পাঁচসালা বন্দোবস্ত : গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ কমিটি' গঠন করেন। যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে রাজি হত, এই ভ্রাম্যমাণ কমিটি তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত প্রদান করত। পুরোনো জমিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব নিতে অক্ষম হলে, তিনি জমিদারি হারাতেন। এই ব্যবস্থা 'ইজারাদারি ব্যবস্থা' বা 'পাঁচসালা বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বতন সুপারভাইজারদের তিনি নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’, যারা জেলার রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাম্যমাণ কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হ...