আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কমিউনিস্ট চিনের প্রভাব
সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পক্ষে এশিয়ার মানচিত্রে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা চিনে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার পত্তন (১৯৪৯ খ্রি., ১ অক্টোবর)। পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ-এর কবল থেকে মুক্ত হয়ে কমিউনিস্ট রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে চিন এশিয়াতে তথা বিশ্বরাজনীতিতে ভারসাম্য আনে। ঐতিহাসিক ফ্রিডমানের মতে—আধুনিককালের আন্তর্জাতিক ঘটনার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় শক্তিরূপে চিনের অভ্যুদয় ।
সাম্যবাদী শিবিরের শক্তিবৃদ্ধি: বিশ্বের দ্বিমেরুকরণ রাজনীতিতে চিনের উত্থান সাম্যবাদী শিবিরে প্রবল শক্তিবৃদ্ধি ঘটায়। চিন ও বিশ্বের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির গঠন করে। চিয়াং-কাই-শেকের শাসনকালে তাঁর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের একটা পরোক্ষ আধিপত্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে মার্শাল এইড্ বা অন্য কোনো মার্কিন সাহায্য ছাড়াই কমিউনিস্ট চিন বিশ্বরাজনীতিতে এককভাবে মাধ্য তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। এই কারণেই কোরিয়া, ভিয়েতনাম বা অন্যান্য দেশের সমস্যায় সে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছে।
সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব: সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে চিনের মৈত্রী বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে। রাশিয়া ওই আন্দোলনকে জোরদার করতে নানাভাবে চিনের শিল্পায়ন, সমরসজ্জা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাহায্য করতে থাকে। শুধু তাই না, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সোভিয়েত রাশিয়া চিনকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সহযোগী নেতৃত্বের আসনেও বসায়। এর ফলে চিন একদিকে যেমন এশীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, অন্যদিকে তেমনি সোভিয়েত ও তার সহযোগীদের বিবাদের মধ্যস্থতা করে গেছে।
সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক:
- (1)সম্পর্কের সূচনা: চিনে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সোভিয়ের রাশিয়ার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। চিনের নাম বিপ্লব সাম্যবাদী বিশ্ব গড়ে তোলার পরে ছিল এক পুরপূর্ণ সোপান। কমিউনিস্ট রাষ্ট্ররূপে চিনের আত্মপ্রকাশের পর সোভিয়েত রাশিয়াই প্রথম তাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল।
- (2) মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর: বন্ধুত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ উভয় দেশের মধ্যে ৩০ বছরের জন্য মৈত্রী চুক্তি (১৯৫০) স্বাক্ষরিত হয়। এর সুফলরূপে সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে চিন সহজ শর্তে ৩০০ কোটি ডলার ঋন পায়। এ ছাড়াও রাশিয়া পোর্ট আর্থার বন্দর ও মাঞ্চুরিয়ার রেলপথের অধিকার চিনের হাতে তুলে দেয়।
- (3) বন্ধুত্বের ফাটল: কিন্তু ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে চিন- সোভিয়েত বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ক্রুশ্চেভের মার্কিন সফরকে চিন পুঁজিবাদী শক্তির সঙ্গে আপস বলেই মনে করে। অবশেষে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে চিন-সোভিয়েত মৈত্রী ছিন্ন হয়ে যায়। সে সমকোর সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কুশ্চেভের নির্দেশে চিন থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার সব প্রযুক্তিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক পরামর্শদাতাদের ফিরিয়ে আনা হয়। আসলে এই দ্বন্দ্বের মূলে ছিল ক্রুশ্চেভের স্টালিন-বিরোধী নীতি যা চিন মেনে নিতে পারেনি এবং মাও জে নভের স্বাধীন মনোভাব। এ ছাড়া কমিউনিস্ট চিন ন্যাটোকে সমর্থন করলে বেজিং ও মস্কোর দ্বন্দ্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়।
আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক:
- (1) সম্পর্কের অবনতি: চিনের সঙ্গে প্রথমদিকে আমেরিকার সম্পর্ক ছিল বৈরিতার। চিনে সাম্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার পর মার্কিন-চিন সংঘাত শুরু হয়। চিনের কমিউনিস্ট বিরোধী চিয়াং-কাই-শেককে সমর্থন করা, রাষ্ট্রসংঘে সাম্যবাদী চিনের সদস্যপন্যের বিরোধিতা করা বা কোরিয়া যুদ্ধের সময় চিনের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ ও পরমাণু বোমা নিক্ষেপের হুমকি দেওয়া ইত্যাদির ফলে মার্কিন-চিন সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কমিউনিস্ট চিনও মার্কিন বিদেশনীতির বিরোধিতা শুরু করে। কাগুজে বাঘ বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমালোচনা করে।
- (2) সম্পর্কের উন্নতি : সাতের দশক থেকে চিন-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষতি ঊতে শুরু করে। চিনের সামরিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নতি, রুশ-চিন দ্বন্দ্ব ইত্যাদি ঘটনা মার্কিন-চিন সম্পর্কের উন্নতিতে সাহায্য করে। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিন ১৭টি) পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং বেশ কিছু পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলে। স্বপ্ন ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। নিক্ষেপ ব্যবস্থাতেও চিন দক্ষতা অর্জন করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রসংঘে চিনের অন্তর্ভুদ্ধির প্রভাবকে আমেরিকা স্বাগত জানায়। মার্কিন বিদেশসচিব স্যার হেনরি কিসিস্তার এবং সুজন মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিকসন, কোন পরপর চিন সফরে আসেন। আবার চিনা মন্ত্রী বেন-শিয়াং-পিং মার্কিন সফরে গেলে তিন-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।
গুরুত্বপূর্ণ এশীয় শক্তি : এতদিন কমিউনিস্ট ভাবধারা ও তার আধিপত্য সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবার কমিউনিস্ট চিনের উত্থানের পর তা এশীয় ভূখণ্ডেও ছড়িয়ে পড়ল। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। চিনকে উপেক্ষা করে যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিসাম্য নির্ধারণ করা আর সম্ভব নয়, এবার সকলেই তা উপলব্ধি করে। এভাবে অচিরেই চিন এশিয়ার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে প্রভাব :
- (1) তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্ব: শুধু এশিয়া মহাদেশই নয়, উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবেও চিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
- (2) সৌহার্দ্যতায় : এশিয়ার পাকিস্তান, ভারত, মঙ্গোলিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের পাশাপাশি আফ্রিকা মহাদেশের বলো, মালি, গিনি, তানজানিয়া, জাম্বিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রও চিনের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
- (3) জোটনিরপেক্ষতায়: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে চিনও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছে।
- (4) আন্তর্জাতিক শান্তিপ্রতিষ্ঠায় : আন্তর্জাতিক শান্তিপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে চিনা প্রধানমন্ত্রী চৌ- এন-লাই-এর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ফলশ্রুতি হিসেবে জেনেভা (১৯৫৪ খ্রি.) ও বান্দুং (১৯৫৫ খ্রি.) সম্মেলনে চিন বৃহৎ শক্তির মর্যাদা লাভ করে।
উপসংহার: বর্তমান বিশ্বে এক শক্তিধর রাষ্ট্ররূপে চিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে চিন স্বাক্ষর করতে আপত্তি জানালে তৃতীয় বিশ্বে চিন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। বিশ্বে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে চিনের উত্থান অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। লেনিনবাদের পথ ধরে মাও জে দঙ এবং দোং-জিয়াও-পিং যে তত্ত্বের অবতারণা করেছেন তাতেই লুকিয়ে রয়েছে আধুনিক সাম্যবাদের মূল সতা, যার সঙ্গে মিশে রয়েছে ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের এই উক্তিটি — সাম্যবাদ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা নয় যা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সানাকান আমাদের কাছে একটি আদর্শ যার সঙ্গে বাস্তবের মিলন ঘটাতে হবে। আমরা সাম্যবাদকে সত্যিকার আন্দোলন বর্তমান অবস্থার অবসান ঘটায়
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন