সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি (Methods of Modern History Writing) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি

সূচনা: জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো ইতিহাসের নিজস্ব লিখন পদ্ধতি রয়েছে।

(1) উৎসের অনুসন্ধান: ইতিহাস লিখনপদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হল ঐতিহাসিক ঘটনার উৎসের অনুসন্ধান করা। ইতিহাস হল  উৎসভিত্তিক, উৎস ছাড়া ইতিহাস হয় না। উৎস আবার নানা ধরনের হয়ে থাকে। যথা—

i. প্রত্নতাত্ত্বিক: জীবাশ্ম, যন্ত্রপাতি, হাড়গোড়, অস্ত্রশস্ত্র, আসবাবপত্র, স্মৃতিসৌধ, স্থাপত্য প্রভৃতি।
ii. মৌখিক: মুখে মুখে এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে প্রচারিত ধর্মীয় বিশ্বাস, পৌরাণিক কাহিনি, অতিকথন, রূপকথা, কিংবদন্তি, কাহিনিমালা, পালাগান, প্রবাদ প্রভৃতি।
iii. ছবিভিত্তিক: চিত্রকলা, নকশা, মানচিত্র প্রভৃতি।

iv. লিখিত বিবরণমূলক: প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, দিনলিপি, চুক্তি বা সন্ধিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, সংবাদপত্র, মুদ্রিত পুস্তক প্রভৃতি। এই সমস্ত উৎসগুলি থেকে ঐতিহাসিক তার প্রয়োজনীয় উৎসের অনুসন্ধান করেন এবং সেগুলির সাহায্যে ইতিহাস রচনা করেন।

(2) উৎস থেকে তথ্য চয়ন: উৎসের অনুসন্ধান শেষে ঐতিহাসিক তার প্রয়োজনীয় উৎসটি চিহ্নিত করেন। এই উৎস থেকে ঐতিহাসিক তার প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সংগ্রহ করেন। কোনো তথ্য অতি প্রয়োজনীয়, কোনোটা আবার মোটামুটি প্রয়োজনীয়, আবার কোনো তথ্য ঐতিহাসিকের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। ঐতিহাসিককে এই প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী উৎস থেকে তথ্য চয়ন করতে হবে।

(3) তথ্যের যাচাইকরণ: ঐতিহাসিক তথ্যগুলি গ্রহণ করার পর সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে সেগুলির যাচাই করে থাকেন। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিককে দুটি কাজ করতে হয়। প্রথমটি হল তথ্যের বাহ্যিক সমালোচনা, আর দ্বিতীয়টি হল তথ্যের অভ্যন্তরীণ সমালোচনা।

(4) তথ্যসমূহের বিশ্লেষণ : ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ইতিহাসের তথ্যসূত্রগুলিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হয়। কোনো বক্তব্য প্রামাণ্য তথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে সেই তথ্যকে সত্য বলে গ্রহণ করা যায়। ঐতিহাসিকের গ্রহণ করা বেশ কিছু তথ্য ব্যক্তিনিরপেক্ষ, যেমন—পুরাতাত্ত্বিক তথ্য, মুদ্রা, প্রাচীন সাহিত্য, সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি। এগুলি হল বাস্তবসম্মত ঐতিহাসিক তথ্য। তথ্যের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্নভাবে করে থাকেন।

(5) ঘটনা ও বক্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন : দুটি ঘটনা বা বক্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা আসলে ঐতিহাসিকের সত্য রক্ষার নীতি বলা চলে যা মূলত চারটি উপাদানের মিলিত রূপ যথা—করেসপন্ডেন্স থিয়োরি, কোহেরেন্স থিয়োরি, অথরিটি ও মেমোরি। করেসপন্ডেন্স থিয়োরি দিয়ে সত্যের সঙ্গে তথ্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। কোহেরেন্স থিয়োরির দ্বারা ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে ঐতিহাসিক সত্যে পৌঁছোনোর চেষ্টা করে থাকেন। অথরিটির ধারণা আসলে পূর্ববর্তী লেখকের লেখাকে সত্য বলে গ্রহণ করা, এই চার ধরনের ঐতিহাসিক সত্যের আলোকে ইতিহাসবিদ তার লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যান।

(6) ধারাবাহিকতা ও কালানুক্রম : ধারাবাহিক কালানুক্রম ইতিহাস রচনাপদ্ধতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যে-কোনো ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সেই ঘটনার সময়কাল উল্লেখ করেন। কালক্রম অনুসারে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিকে তিনপর্বে ভাগ করে আলোচনা করেন, যথা— [i] ঘটনার সূচনাপর্ব বা প্রাথমিক অবস্থা; [ii] ঘটনার গতিপ্রকৃতি বা মধ্যাবস্থা; [iii] ঘটনার পরিণতি বা শেষ অবস্থা। এই তিনটি পর্বের ইতিহাস লেখার সময় ঐতিহাসিকগণ ঘটনার ধারাবাহিকতা বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার কোন্ পর্বটি কোন সময়ে ঘটেছিল তা উল্লেখ করে থাকেন। বর্তমান বিশ্বে ঐতিহাসিকরা খ্রিস্টান কালক্রম অনুসারে ধারাবাহিকভাবে ঘটনা সাজিয়ে তার ইতিহাস রচনা করেন।

(7) কার্যকারণ পদ্ধতি: ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার লিখেছেন, ইতিহাস চর্চার মূল কথা হল ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা। প্রাচীনকালের ঐতিহাসিকরা ঘটনার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করেননি। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস রচনাপদ্ধতিতে কার্যকারণ সম্পর্ক অনুসন্ধান আবশ্যিক। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র দৃশ্যমান বা সহজে বোঝা যায় এমন কারণ অনুসন্ধানই নয়, পাশাপাশি ঘটনার গভীরে লুকিয়ে থাকা কারণ খুঁজে বের করে তার সঠিক উপস্থাপনা দ্বারা ঐতিহাসিক তার লেখাকে সম্পূর্ণতা দেন। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিককে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কারণের অনুসন্ধান করতে হয়। ইতিহাসে সংঘটিত কোনো ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণের জন্য প্রতিটি ঘটনাকে আলাদাভাবে জানতে হয়। এরপর প্রতিটি ঘটনা ঘটার কারণকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করতে হয়।

(৪) তথ্য সংরক্ষণ ও ইতিহাস রচনা: ঐতিহাসিককে তার ইতিহাস রচনা শুরু করার আগে প্রয়োজনীয় তথ্যের সংরক্ষণ করতে হয়। উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং সেগুলি সঠিকভাবে যাচাই করে নেবার পর ঐতিহাসিক যথাযথভাবে তথ্যগুলি সংগ্রহ করে প্রথমেই তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে বা নোট বুকে লিখে রাখেন। ইতিহাস লেখার সময় প্রয়োজন অনুসারে এই তথ্যগুলি তিনি ব্যবহার করে থাকেন।

উপসংহার: আধুনিক ইতিহাসের লিখন পদ্ধতি দিনে দিনে বিবর্তিত হচ্ছে।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রিপস মিশন কেন ভারতে এসেছিল ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব‌ গুলি কী ছিল ? এক্ষেত্রে ভারতীয়দের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ?

সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রি.) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত। ক্রিপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন—আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপস মিশন অপরিহার্য ('The Cripps Mission is indispensable to prove our honesty of purpose') ! পটভূমি / কারণ    ক্রিপস্ মিশনের ভারতে আসার পটভূমি বা কারণগুলি হলো –  [1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্লহারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপাইন, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও ব্রহ্মদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজ...

মার্কেন্টাইল বাদ কি ? এর বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি ?

মার্কেন্টাইলবাদ মার্কেন্টাইল বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডম স্মিথ তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ওয়েল্থ্ অব নেশনস' (Wealth of Nations)- এ ‘মার্কেন্টাইলবাদ' (Mercantilism) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। মার্কেন্টাইলবাদীদের ধারণায় পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। এই মতবাদের মূল কথা হল সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী বলা হয় এই মতবাদ মেনে বিদেশি পণ্য আমদানি কমানোর জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হত। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হল দেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধশালী করে তোলার জন্য নিজ দেশের সোনা রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। মূল বক্তব্যসমূহ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আর্থিক জাতীয়তাবাদ: ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি রাষ্ট্রের অধীনে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। বণিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা গিল্ডগুলির বদলে রাষ্ট্র বণিক ও বাণিজ্য বিষয়গুলির দেখাশোনা শুরু করে। রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে বণিক ও উৎপাদকের স্বার্থকে এক দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়। ফলে জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থনীতি পরিচালিত হতে শুধু করে, যার নাম হয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। মূল্যবান ধাতুর ওপর গু...

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সূচনা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ পূর্বতন মুঘল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বজায় রাখেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে তুলে দেন। কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা [1] পাঁচসালা বন্দোবস্ত : গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ কমিটি' গঠন করেন। যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে রাজি হত, এই ভ্রাম্যমাণ কমিটি তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত প্রদান করত। পুরোনো জমিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব নিতে অক্ষম হলে, তিনি জমিদারি হারাতেন। এই ব্যবস্থা 'ইজারাদারি ব্যবস্থা' বা 'পাঁচসালা বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বতন সুপারভাইজারদের তিনি নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’, যারা জেলার রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাম্যমাণ কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হ...